মালিহা (ছদ্মনাম) কর্মজীবী। তার সন্তান আছে। এক ছাদের নিচে বাস করলেও স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে তেমন মিল নেই। স্বামী সুযোগ পেলেই মালিহাকে মানসিক নির্যাতন করে থাকে। এই লকডাউনের সময় একদিন মালিহার স্বামী মালিহাকে বলেই ফেললেন, বাবা-মা কিছুই শেখাতে পারেনি। সংশোধন না হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। মালিহা এসব দুঃখের কথা তার বান্ধবীর সঙ্গে আলোচনা করেন।
মালিহা বলেন, ‘আর কত সহ্য করব, এক যুগ ধরে সহ্য করছি। মাঝে মাঝে মনে হয় কোথাও গিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি।’ মালিহার স্বামী সারা দিন মুঠোফোন নিয়ে পড়ে থাকলেও মালিহার হাতে মুঠোফোন দেখলেই সন্দেহেরে চোখে দেখে। এই হলো একজন উচ্চশিক্ষিত নারীর ওপর মানসিক নির্যাতনের একটি ছোট গল্প। এমন গল্প অথবা এর চেয়ে আরও অনেক বেদনার গল্প মালিহাদের সহ্য করতে হয়। সমাজের ভয়ে লোকলজ্জার ভয়ে সয়ে যেতে যেতে একদিন তারা হারিয়ে যায়।
অথচ প্রতিনিয়ত লকডাউনে সামাজিকমাধ্যমে নারীদের ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে একজন স্বৈরাচারী হিসেবে। নানা রকমের হাসি-ঠাট্টামূলক ভিডিও চিত্রের ছড়াছড়ি। বাস্তবতা কী আসলেই তাই? যদি তাই হয় করোনাভাইরাসের প্রকোপে লকডাউনে থাকা মালিহা ও তার স্বামী অবস্থা এমন হওয়ার কথা নয়।
সারা বিশ্বে এই মহামারিতে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে যে সংকট রয়েছে, এই সংকটে সবচেয়ে বেশি পড়বেন নারীরা।
গত ৬ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস করোনা মোকাবিলার সঙ্গে পারিবারিক সহিংসতা মোকাবিলা যুক্ত করার কথা বলেছেন।
যুক্তরাজ্যে সরকারি হটলাইনে নারীদের কাছ থেকে আসা ফোন ৬৫ ভাগ বেড়েছে। চীনে নারীর ওপর নির্যাতন তিন গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশে ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৩৮টি মামলা হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ২৫৭ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১২ জন ধর্ষণের পর মৃত্যুবরণ করেছে। ৫০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। চারজন ধর্ষিত হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছে।
তবে নির্যাতক যে কেউ হতে পারে, পুরুষ অথবা নারী। সম্প্রতি দুটি বিষয় চোখে পড়েছে। একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে ফেসবুক লাইভে এসে হত্যা করেছে। আর একজন নারী তার নারী গৃহকর্মীকে আঘাত করেছে। তবে পুরষেরা যে পরিমাণ নির্যাতন করে, সে পরিমাণ পরিসংখ্যান নারীদের মধ্য থেকে পাওয়া যায় না।
সর্বক্ষেত্রে সহিংসতা বন্ধে প্রয়োজন-সচেতনতা, শিক্ষার বিস্তার এবং যারা নির্যাতক তাদের মধ্যে মনুষত্ববোধ জাগ্রত করা। তবে মনুষত্ববোধ জাগ্রত করা নিজের ওপর বর্তায়।
পরিবারে একজন মা যেমন প্রত্যাশা করেন তার মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভালো থাকুক, তেমনি সেই একই মা যখন শাশুড়ি তখন তার ভাবা উচিত, ছেলের স্ত্রীও ভালো থাকুক। যে পুরুষ নির্যাতক তার স্ত্রীকে নানারকম নির্যাতন করছে, সে নিশ্চই তার বোনের ওপর নির্যাতন হোক তা প্রত্যাশা করেন না।
সুতরাং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। সম্পর্কে বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি। স্বামী-স্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করলে এবং দুজনেই চাকরি করলে দুজনেরই পরিচিত অনেকেই থাকবে। সে সম্পর্কগুলোকে সন্দেহের চোখে না দেখে সম্মানের চোখে দেখাই বেশি প্রয়োজন। না হলে অবিশ্বাস, সন্দেহ বাসা বাঁধতে থাকে। পরবর্তীতে দাম্পত্য কলহ দেখা দেয়, যার পরিণাম সহিংসতা।
শুরু করেছিলাম মালিহার গল্প দিয়ে, শেষ-ও করতে চাই তাকে দিয়ে। প্রতিনিয়ত স্বামীর মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে সে এখন জীবনের প্রতি মায়া হারিয়ে ফেলেছে। নারীরা পুরুষের প্রতিযোগী নয়, সহযোগী। একে অপরকে সম্মান করলে, উভয়ের মধ্যে ছাড় প্রদানের মানসিকতার মাধ্যমে এ সমাজ থেকে পারিবারিক সহিংসতা বন্ধ হতে পারে।
ড. জেবউননেছা : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়